নিউজ ডেস্ক :
ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নিজস্ব মতামত, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন তিনি। পাশাপাশি জানালেন অভ্যুত্থান নিয়ে নানা অজানা কথা।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অভ্যুত্থান নিয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতিও স্মরণ করেছেন। ২০২৪ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৭ পর্বে লিখেছেন তিনি। ‘সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান’ শিরোনামে লেখাগুলো নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস-এর পাঠকদের জন্য লেখাগুলো হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানদের প্রায়ই সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান এবং গণবিপ্লবের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর পেছনে দেশের বিশৃঙ্খল ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। কোনো সেনাপ্রধানই নিশ্চিত থাকতে পারেন না যে তাঁর মেয়াদকালে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। বাইরে থেকে পরিস্থিতি শান্ত বোঝা গেলেও, ছোট কোনো ঘটনা হঠাৎ করে দাবানলের সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ১৯৯০ সালে ডা. মিলনের শহীদ হওয়া, কিংবা ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন—সবকিছুই দেখিয়েছে কিভাবে একটি মাত্র ঘটনা জাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত দেখালেও, সম্ভাব্য অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একজন সেনাপ্রধানকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।
‘সেনাবিদ্রোহ’ এমন এক পরিস্থিতি যা সেনাপ্রধানকে দিশেহারা করে পুরো কমান্ড কাঠামোতে অচলাবস্থা তৈরি করে। এর মূল কারণ হলো বিদ্রোহ সাধারণত অপ্রত্যাশিত জায়গায় হঠাৎই ঘটে, আর এর সঙ্গে মিলিত হয় সহিংসতা ও বিধ্বংসী শক্তি। আকস্মিকতা, নেতৃত্ব কাঠামোর ভেঙ্গে পড়া, আর আনুগত্য ও শৃঙ্খলার মনস্তাত্ত্বিক বাঁধন এক লহমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যেখানে দ্রুতই অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি বাসা বাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটে প্রধানত অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সুপ্ত শ্রেণীসংগ্রামের জেরে। পাকিস্তান আমলের ‘মালিক-ভৃত্য’ সম্পর্ক নতুন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বাড়ায়, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের সৈনিকরা যখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের পরিচয় আর কর্তব্য নতুনভাবে নির্ধারণ করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই চাপা উত্তেজনাকে উস্কে দেয় এবং সৈনিকদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার বীজ বুনে রাজনৈতিক ফায়দা লূটে নেয়ার চেষ্টা করে। বহু বিদ্রোহ ঘটলেও, এর মধ্যে তিনটি বড় বিদ্রোহ দেশকে বিশেষভাবে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই পুরো সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। ভাগ্যক্রমে এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। জেনারেল জিয়ার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দ্রুত পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে, ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৪ থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিদ্রোহের কোনো আভাসই পাননি। এমন অমনোযোগের ফলে তিনি তাঁর সদ্য অর্জিত পদ হারান এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন
দ্বিতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ১৯৭৭ সালে যখন ২২ ইস্ট বেঙ্গল ২৯ / ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্রোহ করে এবং ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও ক্ষমতায় টিকে যান, কারণ বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় পর্যায়ের যা সেনাবাহিনীর উন্নত সামরিক কাঠামো দিয়ে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালের বিদ্রোহীরা শাস্তি এড়াতে পারলেও, ১৯৭৭ সালের ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যাপক মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়। এটাই ভবিষ্যতে বিদ্রোহ করতে চাওয়া সৈনিকদের জন্য ছিল স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তা।
তৃতীয় বড় বিদ্রোহ ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সৈনিকরা তিন দিন ধরে চলা সহিংসতায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে বিদ্রোহের আশংকার আভাস থাকলেও, সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেনাপ্রধান, বিডিআর মহাপরিচালক ও ডিজি ডিজিএফআই—সকলেই শুধু পরের দিনের প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল করে স্বস্তিতে বসে থাকেন এবং বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নিছক গুজব মনে করে উড়িয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী হামলার কারণে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামো সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে। তবে অবশেষে বিদ্রোহ দমন করা হয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
Leave a Reply