মোসাব্বীর হোসেন , জবি প্রতিনিধি,
একজন বারো বছরের কিশোর সংসার শব্দটার সাথে কতটুকুই বা পরিচিত। এই বয়সে খেলাধুলা আর দৌড়াদৌড়িতেই তার জীবন অতিবাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে মাত্র বারো বছর বয়সেই সংসার নামক শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছে এক কিশোর। এতো কম বয়সে সংসার শব্দটার সাথে পরিচিত হওয়া এতটা সহজ না। সে কাঁধে তুলে নিয়েছে সংসারের কঠিন বোঝা। কোমল হাতে বিক্রি করছে চা , সিগারেট ও পান।
লক্ষ্মীপুর জেলার ১২ বছর বয়সের কিশোর হামিম ইসলাম রাহাত। বর্তমানে থাকে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানার লক্ষী বাজারের একরামপুরের এক ভাড়া বাড়িতে। সে বানিয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। পড়াশোনার ও সংসারের খরচ একসাথে চলাতে হিমসিম খেতে হয় তাকে। আবার ছোটভাই তৃতীয় শ্রেণীতে একই স্কুলে পড়ে।
সংসারের ও পড়াশোনার খরচ মেটাতে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ছোট্ট দুটি স্টলে চা, সিগারেট ও পান বিক্রি করে তারা। রাহাতের স্বপ্ন বড় হয়ে মস্ত বড় চাকরি করবে, যাতে মায়ের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়।
রাহাতের মায়ের নাম খাদিজা আক্তার। প্রায় বছর তিনেক আগে খাদিজা আক্তারের স্বামী মাসুদ আলম (পেশায় একজন ভ্যান চালক) স্ত্রী-সন্তানকে রেখে বিয়ে করেন অন্য এক মহিলাকে। তারপর থেকেই তাদের দুঃখ-দুর্দশার দিন শুরু। পেটের দায় সাথে দুটি সন্তানকে বড় করতে বাধ্য হয়ে নেমে পড়েন চায়ের ছোট্ট একটি স্টল নিয়ে। তিনি কবি নজরুল কলেজের সামনে চা-পান-সিগারেট বিক্রি করে। একা সবকিছু সামলাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ছোট দুই সন্তানকেও একই পেশায় পাঠিয়েছেন।
খাদিজা আক্তার বলেন,বাপ-মায়ে বিয়ে দিয়েছিল যাতে সুখে শান্তিতে স্বামীর ঘরে থাকতে পারি কিন্তু শুরু থেকেই দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।স্বামী ভ্যান চালিয়ে সংসার সামলাতো। একদিন কাজ করতো কিন্তু দশদিন বসে থাকতো যার কারণে প্রায়ই সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো।
তিনি আরও বলেন, বছর তিনেক হলো রাহাতের বাবা অন্য একজনকে বিয়ে করে তার সাথেই থাকে। আমাদের খরচ চালানো তো দূরে থাক খোঁজখবর পর্যন্ত নেই না।এই ঢাকার শহরে নিজের বলতে কেউ নেই। দুটি সন্তানই আমার কাছে সব।
এসব কথা বলতে বলতে কান্না করে খাদিজা আক্তার বলেন, ওতো ছোট দুই বাচ্চাকে কোন মা কাজে পাঠাতে পারে। পেটের দায়ে আমার ওই অবুঝ বাচ্চাগুলোকে কাজে পাঠাতে হচ্ছে। আমি নিজেও চায়ের দোকান সামলাচ্ছি। কিন্তু বেচাকেনা ঠিক মতো না হলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়।
রাহাত বলেন, পেটের দায়ে চা-পান বিক্রি করছি। মাঝে মাঝে আমার অনেক খারাপ লাগে। আমার বন্ধুরা সবাই খেলাধুলা করে, ঘুরতে যায় কিন্তু আমি এগুলো কিছু করতে পারি না।কারণ এই কাজ না করলে আমাদের সংসার চলবে না।
তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,বড় হয়ে আমি বিজনেস ম্যান হতে চাই।আমার মা অনেক বেশি কষ্ট করে আমাদের জন্য। চাকরি করে আমার মায়ের দুঃখ কষ্ট দূর করতে চাই।
বানিয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস স্মৃতি বলেন, বাচ্চা দুইটা আমাদের স্কুলে ফেব্রুয়ারিতে নতুন ভর্তি হয়েছে।রাহাত খুবই শান্তশিষ্ট এবং মেধাবী ছাত্র। তারা দুজন কাজ করে একইসাথে পড়াশোনাও করে তাছাড়া তাদের আর্থিক সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। সরকারি স্কুল থেকে যা যা সাহায্য পাওয়ার কথা তা তারা সবই পাচ্ছে এবং সামনে উপবৃত্তি দেওয়া হলে সেটাও তারা পাবে।
এই বিষয়ে চিলড্রেন ওয়াচ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শাহ ইসরাত আজমেরীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন,সচরাচর পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে শিশুরা কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যার কারণে অঙ্কুরেই তাদের জীবন বিনষ্ট হয়ে যায়। আমাদের আশেপাশে এমন শিশুর সংখ্যা অহরহ যারা খেলাধুলা ও পড়ালেখার বয়সে কাঁধে তুলে নিচ্ছে সংসারের দায়িত্ব।
তিনি আরো বলেন,সরকারের উচিত এই ধরনের বিষয়ে নজর দেওয়া। তাদের জন্য বিভিন্ন উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে তাদের মানসিক অবস্থা উন্নতির জন্য নিয়মিত কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।এমন ছোট ছোট উদ্যোগ নিলে শিঘ্রই শিশুশ্রম এর হার কমে আসবে বলে আশা করছি।
Leave a Reply